দিন যতই যাচ্ছে ততই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শ্রম অভিবাসীর সংখ্যা বাড়ছে। আশার কথা হলো একই সাথে বাড়ছে নারী শ্রম অভিবাসীর সংখ্যাও। গ্রামের একেবারে দরিদ্র অসহায় পরিবারের মেয়েরা সম্প্রতি জিরো মাইগ্রেশন খরচে সৌদিআরব, জর্ডান, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে কাজে নিযুক্ত হচ্ছেন। নারী শ্রম অভিবাসী হওয়ার হার কেবলই বাড়ছে। অনেক অসহায়, দরিদ্র পরিবারের মেয়েই এখন বিদেশে শ্রমে নিযুক্ত হয়ে নিজ পরিবারে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য আনতে পেরেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে নারী অভিবাসনের অগ্রগতি অবশ্যই আমাদের অর্থনীতিতে নতুন শক্তির সঞ্চার করছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ব্যুরো অফ ম্যান পাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট এন্ড ট্রেনিং (বিএমইটি)-এর তথ্য মতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মোট শ্রম অভিবাসীর সংখ্যা ১ কোটি ১৪ লক্ষ ৬৪ হাজার ৯৪৩ জন। এর মধ্যে নারী শ্রম অভিবাসীর সংখ্যা ৬ লক্ষ ৯৬ হাজার জন। নারী শ্রম অভিবাসীদের বড় অংশ মূলত সৌদিআরব, আরব আমিরাত, ওমান, জর্ডান, লেবানন, কুয়েত, মালয়েশিয়া এসব দেশে কর্মরত রয়েছেন। সর্বশেষ ২০১৭ সালে মোট নারী শ্রম অভিবাসী হয়েছেন ১ লক্ষ ২১ হাজার ৯৮৫ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮৩ হাজার জন গেছেন সৌদি আরবে। এর বাইরে কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, আরব আমিরাত, জর্ডান, লেবানন, মালয়েশিয়াতে গেছেন অন্যরা।
নারী শ্রম অভিবাসীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি সৌদিআরবে। বিএমইটির তথ্য মতে, বর্তমানে সৌদি আরবে ২ লক্ষ ৪ হাজার ৭২৯ জন বাংলাদেশী নারী অভিবাসী রয়েছেন। অর্থাৎ মোট অভিবাসীর প্রায় ৩০ শতাংশই সৌদি আরবের বিভিন্ন জায়গাতে কর্মরত রয়েছেন। এর পরপরই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নারী অভিবাসী দেশ হলো জর্ডান। সেদেশ বর্তমানে ১ লক্ষ ২৯ হাজার ৮০২ জন নারী অভিবাসী রয়েছেন। শতাংশের হিসেবে মোট নারী অভিবাসীর ১৮.৬৫ শতাংশ জর্ডানে রয়েছেন। এরপর তৃতীয় সর্বোচ্চ ১ লক্ষ ২৬ হাজার ১ জন নারী অভিবাসী রয়েছেন আরব আমিরাতে। লেবাননে রয়েছেন ১ লক্ষ ৪ হাজার ২০৭ জন। ওমানে রয়েছেন ৬৪ হাজার ৬০২ জন। বিদেশ বিভূঁই-এ বেশিরভাগই নারী গৃহ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এর বাইরে পোশাক শিল্প, হাসপাতাল এবং বিভিন্ন কলকারখানাতে নারীরা অভিবাসীরা কাজের সাথে যুক্ত।
১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশের পুরুষদের পাশাপাশি বৈশ্বিক শ্রমবাজারে নারীরা প্রবেশ করলেও সেটা ছিল একেবারেই সীমিত পরিসরে। প্রথম দিকে মূলত দক্ষ নারীরাই বিদেশে কর্ম করার সুযোগ লাভ করে। পরবর্তীতে স্বল্প বা কম দক্ষ নারীদেরও বিদেশে যাওয়ার সূর্যোগ্য তৈরি হয়। কিন্তু বহুবিধ কারণে এবং নানান শর্তারোপের জালে পড়ে নারীদের বিদেশগামীতা কমে যেতে থাকে। কখনও কখনও বিবিধ নিষেধাজ্ঞও দেওয়া হয়। তবে ২০০৩ সালে সরকার নারীদের বিদেশ যাওয়ার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলে আবার নতুন করে বিদেশে বাংলাদেশের নারী কর্মীদের চাহিদা তৈরি হয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক গবেষণায় দেখা যায় ১৯৯১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত অভিবাসীদের মধ্যে নারী অভিবাসীদের হার ছিল মাত্র ১ শতাংশ । কিন্তু ২০০৩ সালে নারী অভিবাসন বিষয়ে নীতিমালা পরিবর্তনের কারণে ২০০৯ সালে নারী অভিবাসনের হার ৫ শতাংশে উত্তীর্ণ হয়। অভিবাসী নারীদের এই হার এখন দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু এই নয়, পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে পুরুষের তুলনায় উপার্জিত অর্থ নারীরা বেশি পরিমাণে দেশে প্রেরণ করে থাকে। যেখানে বেশিরভাগ পুরুষ শ্রমিক গড়ে ৫০ শতাংশ টাকা দেশে প্রেরণ করে থাকে। সেখানে নারী শ্রমিকেরা গড়ে ৯০ শতাংশ টাকা দেশে প্রেরণ করে থাকে।
বিদেশের মাটিতে কেমন আছেন আমাদের শ্রম অভিবাসী সংগ্রামী, লড়াকু নারীরা? যারা জীবন এবং সংসারের সব মায়া ত্যাগ করে শুধু দুটো ডাল ভাতের নিশ্চয়তার জন্যে পরিবার পরিজন ছেড়ে বিদেশের মাটি কামড়ে পড়ে আছেন। আমরা বোধ হয় এক কথায় বলতে পারি বিদেশের মাটিতে নারী অভিবাসীদের বড় অংশই খুব একটা ভালো নেই তারা। সার্বিক নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার বিচারে তারা বেশ নাজুক অবস্থার মধ্যে পতিত। অনেক জায়গাতে তাঁরা বহুবিধ ঝুঁকির মধ্যেও রয়েছে। ফলে আমরা প্রায়ই নারী শ্রমিকদের দুসহ যন্ত্রণা ও বেদনার কথা শুনতে পায়। পত্রিকার পাতাতে দেখতে পাই বিদেশের মাটিতে নারী নির্যাতনের বহুবিধ খবর। ইউটিউব-এ অনেক নির্যাতিত নারীর করুণ আর্তনাদ দেখে মন কেঁদে উঠে। শিহরিত হই।
বলতে দ্বিধা নেই অনেক নারী শ্রমিক নিপীড়িত নির্যাতিত হয়ে কারো সহায়তা না পেয়ে নীরবে নিভৃতে দেশে ফিরে এসেছেন। তবে নারী নির্যাতনের চিত্রটা বেশি বোধ হয় সৌদি আরবেই। সৌদিআরবে বাংলাদেশী নারী নির্যাতনের চিত্র নতুন নয়। দৈহিক নির্যাতন, ধর্ষণ, অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তোলা, পাশবিক নির্যাতন-এরকম শত শত অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বেশিরভাগ নারী শ্রমিকের কর্মস্থল হলো সৌদিআরব। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশের মেয়েদের পূর্ণ নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত হয়নি। সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস সংলগ্ন সেইফ হোমে নির্যাতিত নারী শ্রমিকের সংখ্যা কেবল বেড়েই চলেছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নির্যাতিত নারীরা সেইফ হোমে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন। এমন কথাও জানা গেছে অনেক নারী সেইফ হোমে এসে সন্তান প্রসব করেছেন। এই অপ্রিয় সত্যগুলো এখন মেনেও নিতে হচ্ছে। সৌদিআরব, জর্ডানসহ কয়েকটি দেশ থেকে নির্যাতনের কারণে অনেক নারী শ্রমিককে মৃত্যুর মুখ থেকে দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হতে হয়েছে।
যে কথা আগেই বলেছি সর্বশেষ বছরে প্রায় জিরো মাইগ্রেশন খরচে নারী শ্রমিক গমন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা এমনও দেখেছি গ্রামের যে মেয়ে আগে কখনও নিজ জেলা শহরে যায়নি সেও নাম মাত্র খরচে কাজের সন্ধানে পাড়ি জমিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে। কিন্তু আগের তুলনায় নারী কর্মী গমন বৃদ্ধি পেলেও তাদের বেতন বৃদ্ধি এবং সুরক্ষার বিষয়ে কার্যকর কৌশল ও পরিকল্পনা সেই অর্থে দৃশ্যমান হয়নি। একই সাথে সৌদিআরব, জর্ডান, লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নিয়োগকর্তা কর্তৃক নির্যাতিত নারী কর্মীদের অভিযোগ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা করতে না পারাটাও আমাদের অক্ষমতা। এক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের নতুন কৌশল বের করা প্রয়োজন।
আমরা জানি আমাদের যেসব নারীরা সৌদিআরবসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গেছে তারা প্রায় সবাই অসহায় দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। অনেকেই স্বামী পরিত্যক্ত বা তালাক প্রাপ্ত। জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে করতেই এসব মেয়েরা জীবন বাঁচানোর জন্যে বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু এই সব নারীদের জন্যে যদি আমরা সেবা এবং সহযোগিতা হাত বাড়াতে না পারি তাহলে আমরা কোনোভাবেই তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবো না।
গত ৪ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ দিন ব্যাপী রাজধানী ঢাকাতে যে শ্রম কল্যাণ সম্মেলন হয়ে গেল সেখানে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সাথে নারী শ্রম অভিবাসীদের অভিযোগ-অনুযোগ বিষয়ের অবতারণা করেন। এ বিষয়ে লেবার এটাচদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, শ্রম কল্যাণ উইং-এ দূর-দূরান্ত থেকে যে সকল কর্মীরা আপনাদের কাছে সেবা নিতে আসে তারা যেন হাসি মুখে সেবা নিয়ে কর্মস্থলে ফিরে যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সেবা পেতে তাদের সময়, ভিজিট ও যাতায়াত খরচ কমানোর দিকে সজাগ থাকবেন। কোন কর্মীই যেন সেবা না নিয়ে ফিরে যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। শ্রমকল্যাণ সম্মেলনে অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সমস্যা ও আগামীদিনের সম্ভাবনা নিয়ে। আলোচনার পাদপ্রদীপে এ বিষয়টি আনার জন্যে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
নারী অভিবাসীদের নিয়ে এমনিতে খুব একটা আলোচনা হয় না, যতোটা হয় পুরুষ কর্মীদের নিয়ে। সেই নিরিখে নারী অভিবাসন বিষয়টি একেবারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে আলোচনার টেবিলে উঠে আসা আলাদা গুরুত্ব বহন করে। আশা করি লেবার এটাচেসহ বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তারা নারী শ্রম অভিবাসীদের বিষয়ে আরও সংবেদনশীল হবেন। তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় সঠিক ভূমিকা পালন করবেন। নির্যাতিতা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াবেন এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।