বিদেশে যেতে চাওয়া শ্রমিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হচ্ছে। সরকার ৭৯,০০০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও তাদের কাছ থেকে ৪ লক্ষ পর্যন্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে অভিবাসন ফি হিসেবে।
সরকার থেকে নির্ধারিত ফি ঘোষণা হওয়া সত্ত্বেও শ্রমিক হিসেবে যেতে অতিরিক্ত খরচের অভিযোগ উঠেছে। তবে এরপরেও ব্যাপক চাহিদা থাকা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে প্রচুর শ্রমিক রপ্তানি করা হচ্ছে। গত মাসে মালয়েশিয়াতেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শ্রমিক পাঠিয়েছে বাংলাদেশ।
ব্যুরো অফ ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেডিংয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসেই মালয়েশিয়া ২৫ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়েছে, যেখানে গত বছর সর্বমোট ৫০,০৯০ জন শ্রমিক নিয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি।
এই বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সর্বমোট ১,০৪.৫১৩ জন শ্রমিক রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে সৌদি আরবে সর্বোচ্চ ৪২,৬৯৭ জন (৪০.৮৫%), মালয়েশিয়ায় ২৪,৯৯৪ জন (২৩.৯১%), ওমানে ১৭,৬৯৪ জন (১৬.৯৩%) এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৬,৫৮৪ জন (৬.৩০%)।
মালয়েশিয়ায় এই হারে বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ করা হলে বাংলাদেশ এই বছরে ৩ থেকে ৪ লক্ষ শ্রমিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে পাঠাতে পারবে।
তবে এই খাতে জড়িত থাকা ব্যক্তিরা বলেছেন, বিদেশে যেতে চাওয়া শ্রমিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হচ্ছে। সরকার ৭৯,০০০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও তাদের কাছ থেকে ৪ লক্ষ পর্যন্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে অভিবাসন ফি হিসেবে। তারা এই খাতের সাথে জড়িত থাকা বিভিন্ন সিন্ডিকেটকে এ জন্য দায়ী করেন।
বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক পাঠানোর রেজিস্টার্ড এজেন্সি দেড় হাজারের বেশি হলেও বর্তমানে মাত্র ১০০টি এজেন্সিকে শ্রমিক পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে যেতে চাওয়া একজন টিবিএসকে বলেন, “আমি কন্সট্রাকশন শ্রমিক হিসেবে যাওয়ার জন্য এক এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করি। তারা ৩.৬৫ লাখ টাকা নিলেও আমাকে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়। তারপর আমি আরো কয়েকটি এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করি, যারা ৪.২০ লক্ষ থেকে ৪.৪০ লক্ষ টাকা চেয়েছে।”
তিন মাস মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক অভিবাসন বন্ধ থাকার পর ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়া পুনরায় চুক্তি স্বাক্ষর করে। তবে শ্রমিক পাঠাতে পারবে এমন এজেন্সির সংখ্যা সীমিত করে দেওয়ার ফলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে গত বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি বন্ধ ছিল।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) জয়েন্ট সেক্রেটারি মো. টিপু সুলতান জানান, “প্রাথমিকভাবে, এই অভিবাসনের জন্য খরচ হয় ৩ থেকে ৪ লাখ টাকার মধ্যে। তবে সিন্ডিকেটের কারণে এই খরচ বেড়ে গিয়েছে, এজেন্সিগুলোকে বিভিন্ন স্তরে টাকা দিয়ে এই কাজ করতে হয়। তবে আমরা আশা করি এই সিন্ডিকেট খুব দ্রুত বন্ধ করা হবে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সরকার শ্রমিক শোষণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছি।”
এরকম অবস্থায় দুই দেশই চুক্তি পুঃনিরীক্ষা করতে সম্মত হয়েছে এবং খরচ কমানো ও পুরো প্রক্রিয়া দ্রুত করা যায় কিনা সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া সূত্র থেকে জানা যায়, মার্চের প্রথম সপ্তাহেই এ ব্যাপারে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
এই মাসেই বাংলাদেশ সফরের সময় মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসুসান ইসমাইল জানান, “আমরা নিয়োগ প্রক্রিয়া আরো দ্রুত করার ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং মালয়েশিয়ার সরকারও অভিবাসন খরচ কমাতে বদ্ধপরিকর।”
বায়রার প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ আবুল বাশার টিবিএসকে জানান যে, তারা শ্রমিক অভিবাসনে সিন্ডিকেটগুলোর দৌরাত্ম্য কমাতে বদ্ধপরিকর এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে মালয়েশিয়ায় সর্বোচ্চ পরিমাণ শ্রমিক পাঠানোর জন্য।
মালয়েশিয়ার সরকারের নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী, নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকরা কমপক্ষে ১,৫০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিট (৩৭,০০০ টাকা) পাবেন। এগুলো ছাড়াও মালয়েশিয়ার আইন অনুযায়ী ওভারটাইম, বিনামূল্যে আবাসন, স্বাস্থ্যবীমা, দুর্ঘটনা বীমার মতো সকল সুযোগ-সুবিধা পাবে তারা।
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মতে, বাংলাদেশের মতো একইরকম আবহাওয়া এবং ভালো বেতন কাঠামোর কারণে বাংলাদেশি শ্রমিকরা অন্যান্য দেশের তুলনায় মালয়েশিয়ায় যেতে পছন্দ করেন। কৃষিখাত থেকে শুরু করে, পণ্য উৎপাদন, সেবাখাত, মাইনিং, কন্সট্রাকশন এবং গৃহস্থালি সেবা পর্যন্ত সবক্ষেত্রেই বাংলাদেশি শ্রমিকদেরকে নেবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে।
এমআইডিএফ রিসার্চ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সূত্র ধরে মালয়মেইল নামের একটি পত্রিকা জানিয়েছে, মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি সচল হওয়ায় এবং অন্যান্য খাত বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য মালয়েশিয়া আরো উন্মুক্ত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি জানায়, “দেশীয় চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন কন্সট্রাকশন প্রকল্প চালু, কাঁচামাল উৎপাদন এবং রপ্তানির বৃদ্ধির কারণে মালয়েশিয়ার চাকরির বাজার বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক নির্বাচন মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক টানাপোড়েন অনেকটা স্বাভাবিক করেছে, যার ফলে বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি প্রয়োগ করা আরো সহজ হবে।”
২০২২ সালে মোট ১১,৩৫,৮৭৩ জন শ্রমিক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যেটি ২০২১ সালে ৬,১৭,২০৯ জন ছিল। তবে গত বছরের অর্থনৈতিক ধ্বস এবং মুদ্রা বিনিময় হারের বিভিন্নতা দেখা দেওয়ায় হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় ২০২২ সালে রেমিট্যান্সের পরিমাণ তার আগের বছরের তুলনায় কমে গিয়েছে। ২০২২ সালে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২১.২৯ বিলিয়ন ডলার, অন্যদিকে ২০২১ সালে ছিল ২২.০৭ বিলিয়ন ডলার।
শ্রমিক অভিবাসনের হার ৮২% বাড়লেও রেমিট্যান্সের হার তেমন বাড়েনি। বিদেশের চাকরি খাতের বিশ্লেষকদের মতে, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকদেরকে দেশে টাকা পাঠাতে আরো কয়েক মাস সময় লেগে যাবে।