নিজস্ব প্রতিবেদক
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগ ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে দরিদ্র, নারী, প্রান্তিক ও বিপন্ন জনগোষ্ঠীর অভিবাসনের মাত্রা সাম্প্রতিককালে অনেক বেড়েছে। মানুষ নানা কারণে অভিবাসী হলেও জলবায়ু পরিবর্তন কারণে বাধ্য হয়েই নিকটবর্তী উপশহর কিংবা দূরবর্তী শহরগুলোতে চলে যাচ্ছে।
রাজধানীতে ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিবাস এবং জেন্ডার–সহিষ্ণু কর্মসূচি’ শীর্ষক এক কর্মশালায় বক্তারা কথাগুলো বলেন। বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস) এবং জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউএন-উইমেন ও সহযোগী সংগঠনগুলো এ কর্মশালার আয়োজন করে।
কর্মশালায় উল্লেখ করা হয়, অভিবাসন বাড়লেও প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা, দক্ষতা, সচেতনতা এবং জ্ঞানের অভাবে অভিবাসী জনগোষ্ঠী শহরের বস্তি কিংবা অন্যত্র মানবেতর জীবন যাপন করছে। অভিবাসী পরিবারের নারী, শিশু, কিশোরী, প্রতিবন্ধী এবং বয়স্ক মানুষরা তুলনামূলক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এই পরিপ্রেক্ষিতে জলবায়ু অভিবাসন মোকাবিলার জন্য সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, যথাযথ মনিটরিং, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি এবং জেন্ডার সংবেদনশীল কর্মসূচি গ্রহণ জরুরি।
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বিসিএএসের নির্বাহী পরিচালক আতিক রহমান। বিসিএএসের গবেষণা ফেলো দ্বিজেন মল্লিক কর্মশালায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দুর্যোগঝুঁকি এবং জলবায়ু অভিবাসন নিয়ে সম্পাদিত গবেষণার বিষয়ে আলোকপাত করেন। বাংলাদেশের দুর্যোগপ্রবণ পাঁচটি অঞ্চলে (জামালপুর, কুড়িগ্রাম,কক্সবাজার, সাতক্ষীরা এবং খুলনা) এই গবেষণা পরিচালিত হয়েছে।
দ্বিজেন মল্লিক বলেন, প্রকল্প এলাকার দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপন্ন জনগোষ্ঠী বিশেষ করে দরিদ্র, নারী, প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে যেমন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি অনেকে তাদের এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতেও বাধ্য হচ্ছে। জলবায়ু অভিবাসীর সংখ্যা আগামী দিনগুলোতে আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি সতর্ক করেন।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ইউএন উইমেনের জলবায়ু অভিযোজন ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কর্মসূচির প্রধান দিলরুবা হায়দার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসনের প্রকৃতি ও ধরন অন্যান্য অভিভাবসন থেকে আলাদা। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসনবিষয়ক আলোচনা ও কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষেত্রে সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং পরিবার ও সমাজে নারী-পুরুষের দায়িত্ব–কর্তব্য ভালোভাবে বোঝা দরকার। কারণ, দুর্যোগে নারীর বিপন্নতাই শুধু উঠে আসে কিন্তু নারীরা দুর্যোগ মোকাবিলায় যে ভূমিকা রাখে ও দায়িত্ব পালন করে সেই বিষয়গুলো অনেক ক্ষেত্রে অনুচ্চারিত থেকে যায়। অভিবাসী পরিবারের নারীরা যাতে নিজের এবং পরিবারের দুর্যোগ মোকাবিলা সঠিকভাবে করতে পারেন, সে জন্য তাদের আরও দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে তোলা দরকার। তিনি গুণগত গবেষণার পাশাপাশি সংখ্যাগত গবেষণা এবং সুনির্দিষ্ট সুপারিশ ও কর্মসূচির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
বিসিএএসের জ্যেষ্ঠ গবেষক শেখর কান্তি রায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দুর্যোগ ঝুঁকি নিরূপণ (সিআরএ) ও জলবায়ু অভিবাসনবিষয়ক গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন। মাঠ গবেষণার ফলাফলে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগ ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে অভিভাবসনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে এই প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনের মতো দৃশ্যমান বড় দুর্যোগগুলোর পাশাপাশি লবণাক্ততা এবং সমুদ্রের পানির স্তর বৃদ্ধির মতো দীর্ঘমেয়াদি এবং ধীরে ধীরে সংঘটিত দুর্যোগের কারণে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের দরিদ্র, শ্রমজীবী মানুষেরা এলাকায় জীবন–জীবিকার সংকটে ভুগছেন। তাঁরা জীবিকার সন্ধানে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। নতুন কর্মস্থলে তাঁরা মজুরিবৈষম্য, মানবেতর জীবনযাপনের সম্মুখীন হচ্ছেন।
অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচক বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের পরিচালক মো. খায়রুজ্জামান বলেন, জলবায়ু অভিবাসীদের উন্নয়নে কাজ করার জন্য সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার। তিনি জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
অনুষ্ঠানে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম), ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও), ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইসিসিসিডিডি), মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।